কাতারে গৃহব’ন্দি বাংলাদেশি পরিবারের মা’নবেতর জীবন

মোহাম্মদ আলী। ফেনী সদর উপজেলার সুবলপুর গ্রামের এই বাসিন্দা ২২ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছিলেন। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলেন প্রায় ২০০ বাংলাদেশি। কিন্তু একটি ‘কুচ;ক্রী’ মহলের রোষানলে পড়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দূতাবাসের ‘আবদার’ না মানায় কেড়ে নেয়া হয়েছে তিনিসহ তার স্ত্রী-সন্তানের পাসপোর্ট। অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একটি মহল তাকে নানাভাবে হেনস্থা করেই চলেছে। একের পর এক মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলা কাতারি আদালতে বারবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

কিন্তু রোষানল থেকে রেহাই পাননি তিনি। ফেরত পাননি তিন বছর আগে কেড়ে নেয়া পাসপোর্ট। এমনকি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মোহাম্মদ আলী ও তার পরিবারের পাসপোর্ট ফেরত দিতে সময় বেঁধে দিলেও তার তো;য়াক্কা করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সদ্য জন্ম নেয়া চার মাসের সন্তানের পাসপোর্টও করতে পারেননি। ফলে সপরিবারে দেশটিতে মানবেতর জীবনযা;পন করছেন তিনি।

অনেকটা গৃহবন্দি। আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় এবং বাইরে চলাচল করতে না পারায় দেশে থাকা তার মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, কাজ হা;রি;য়ে সং;ক;টে পড়েছেন তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলাদেশিরা। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের হ;স্তক্ষে;প কামনা করেছেন তিনি। পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে আবারো ব্যবসায় ফিরতে চান, দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে চান এই রেমিট্যান্সযো;;দ্ধা।

মোহাম্মদ আলীর অভি;যোগ ও সংশ্লিষ্ট নথি থেকে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে তিনি জীবিকার সন্ধানে কাতারে যান। প্রথম দিকে অন্যের অধীনে কাজ করতেন। ধীরে ধীরে তিনি ব্যবসার পথ ধরেন। খুব অল্প সময়ে ব্যবসায় উন্নতি করেন। ব্যবসার প্রসার হওয়ায় ২০০ জন লোক নিয়োগ দেন তিনি। এক সময় স্ত্রী-সন্তানকেও নিয়ে যান। ব্যবসার পরিধির প্রসারের পাশাপাশি বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তার সুনামও ছড়িয়ে পড়ে। আর এটাই কাল হয় মোহাম্মদ আলীর।

মোহাম্মদ আলী জানান, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ডেকে নিয়ে তার কাছে ১০টি ভিসা দাবি করেন। একইসঙ্গে তাদের কিছু লোকজনকে তার কোম্পানিতে চাকরি দিতে বলেন। তাদেরই একজনকে কোম্পানির একাউটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে জো;রাজু;রি করেন। কিন্তু দূতাবাস কর্মকর্তার এ অন্যায় ‘আবদার’ রাখতে না পারায় তাকে দেখে নেয়ার হু;;ম;কি দেয়া হয়।

কিছুদিন পর দূতাবাসের আ;স্থাভা;জন একজনকে দিয়ে তার বি;রু;দ্ধে মিথ্যা অভি;যোগ করানো হয়। এ অভি;যোগের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৫শে অক্টোবর দূতাবাস তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। কিন্তু তার বি;রু;দ্ধে আনা অভি;যোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় কাতার আদালত ৪ দিন পর ২৯শে অক্টোবর তাকে জে;লহা;জত থেকে মুক্তি দেন। আদালতে নি;র্দো;ষ প্রমাণিত হলেও দূতাবাসের অসা;ধু কর্মকর্তারা তার পিছু ছাড়েননি।

তারা নতুন কৌ;শ;ল অবলম্বন করেন। কথিত অভি;যোগের আপসের কথা বলে মোহাম্মদ আলীকে ডেকে নিয়ে তার পাসপোর্ট জ;ব্দ করে। একইসঙ্গে প্রতিনিয়ত মিথ্যা অভি;যোগ দিয়ে পুলিশে ধ;রি;য়ে দেয়। তার ব্যবসায়িক শ;ত্রু ও কুচ;ক্রী মহলের যোগসাজশে বারবার ‘মিথ্যা ও হ;য়রা;নিমূ;লক’ মামলা করে। কিন্তু প্রতিবারই কাতারি আদালতে এসব মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পরে চাপ সৃষ্টি করে সাদা কাগজে তার স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করেন দূতবাসের অসাধু কর্মকর্তা। বিভিন্ন হু;;ম;কি-ধ;ম;কি দেন তারা।

এদিকে নি;র্দো;ষ প্রমা;ণিত হয়ে আদালত থেকে খালাস পাওয়ার পর মোহাম্মদ আলী তার পাসপোর্ট ফেরত চাইলে কাতার দৃতাবাসের কর্মকর্তারা পুনরায় তার বি;রু;দ্ধে ‘মিথ্যা’ অভি;যোগ আনে। ওই বছরের ২৭শে ডিসেম্বর পুলিশে সোপর্দ করে। আবারো আদালত থেকে নি;র্দোষ প্রমাণিত হন তিনি।

এভাবে কয়েক দফা তার বি;রু;দ্ধে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ মা;মলা দেয়া হয়। প্রতিবারই নি;র্দো;ষ প্রামণিত হন। কিন্তু পাসপোর্ট ফেরত পাননি মোহাম্মদ আলী ও তার পরিবার। বারবার আবেদন-নিবেদন করেও কোনো ফল পাননি। এ অবস্থায় পরিবারটি কাতারে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযা;পন করছে। স্বাভাবিক চলাফেলা বা কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে।

মোহাম্মদ আলীর অভি;যোগ, ব্যবসায়িক পার্টনার আবদুল গোফরানের কাছে তার ১ লাখ ৮৯ হাজার রিয়াল পাওনা ছিল। এ ছাড়াও মালামাল ও লেনদেন বাবদ আরো প্রায় ৩ লাখ কাতারি রিয়াল পাওনা ছিল তার। ওই পাওনা পরিশোধ না করায় তার বি;রু;দ্ধে কাতার সুপ্রিম কোর্টে ২০১৯ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর একটি অভি;যোগ দাখিল করেন মোহাম্মদ আলী। ফলে ওই ব্যবসায়িক পার্টনার ও দূতাবাস আবারো ষ;ড়য;ন্ত্রে লিপ্ত হয় তার বি;রু;দ্ধে।

তাকে মামলায় ফাঁ;সা;তে না পেরে এবার তার স্ত্রী ঝর্ণা আক্তারকে দূতাবাসে ডেকে নেয়। স্বামীর বি;রু;দ্ধে বক্তব্য দিতে তার ওপর চা;প সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু স্ত্রী ঝর্ণা তাদের ইচ্ছামতো বক্তব্য দিতে রাজি না হওয়ায় তার পাসপোর্টও জ;ব্দ করা হয়। সঙ্গে তার শিশুপুত্রের পাসপোর্টও। কোনো কারণ ছাড়াই এসব পাসপোর্ট আজও ফেরত দেয়া হয়নি। তাদের বি;রু;দ্ধে; কী ধরনের অভি;যোগ রয়েছে তাও জানানো হয়নি। এ বিষয়ে একাধিকবার রা;ষ্ট্রদূত বরাবর আবেদন করলেও কোনো সুরা;হা হয়নি।

এদিকে, পাসপোর্ট ফেরত না দেয়ায় ২০১৮ সালে ৯ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ হাইকোর্টে রিট করেন মোহাম্মদ আলীর পিতা হোসেন আহমদ। এতে বি;বা;দী করা হয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, কাতারস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত, কনস্যুলেট জেনারেল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ফেনীর ডিসিকে।

ওই রিটের প্রেক্ষিতে আদালত এক মাসের মধ্যে পাসপোর্ট ফেরত দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। কিন্তু আদালতের সেই আদেশও অজ্ঞা;ত কারণে পালন করেনি দূতাবাস বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পরে ২০১৯ সালের ১২ই মার্চে আরো একটি রিট করেন হোসেন আহমদ। হাইকোর্ট এই রিটের প্রেক্ষিতে পুরাতন পাসপোর্ট নবায়ন বা নতুন করে পাসপোর্ট দিতে আদেশ দেন।

এই আদেশের বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়। ওই আপিলও খা;রিজ করে দেন আদালত। কিন্তু অজ্ঞা;ত কারণে আজও পুরাতন পাসপোর্ট ফেরত বা নতুন পাসপোর্ট পাননি মোহাম্মদ আলী ও তার পরিবার।

এ বিষয়ে হোসেন আহমদের আইনজীবী এডভোকেট খান জিয়াউর রহমান বলেন, আমরা দুটি রিট করেছি। দুটি রায়ই আমাদের পক্ষে। বিবা;দী পক্ষ একটি আপিল করেছেন সেটাও খারি;জ হয়ে গেছে।

এই অবস্থায় পাসপোর্ট ফেরত পেতে আর কোনো আইনি জ;টি;লতা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী এবং তাদের ছোট বাচ্চার পাসপোর্ট জ;ব্দ করে কোনো আইনে? বিষয়টি মানবিকতার ল;ঙ্ঘ;ন বলেও উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী। এ বিষয়ে জানতে কাতারস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের একাধিক কর্মকর্তার ফোনে চে;ষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

রোকনুজ্জামান পিয়াস,
মানবজমিন